বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘রহস্য পুরুষ’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন সিরাজুল আলম খান। তিনি ছিলেন রাজনৈতিক তাত্ত্বিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। জাতীয়তাবাদী চেতনাকে বিকশিত করে বাংলাদেশিদের স্বাধীন জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে ১৯৬২ সালে গোপন সংগঠন গড়ে তোলেন তিনি। নিউক্লিয়াস নামে গড়ে ওঠা সংগঠনের তিনিই ছিলেন মূল উদ্যোক্তা। নিউক্লিয়াস ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ নামেও পরিচিত। ১৯৬৯-৭০ সালে গণআন্দোলনের চাপে ভেঙে পড়া পাকিস্তানি শাসনের সমান্তরালে ‘নিউক্লিয়াস’-এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সংগঠন করা হয় ছাত্র-ব্রিগেড, যুব-ব্রিগেড, শ্রমিক-ব্রিগেড, নারী-ব্রিগেড, কৃষক-ব্রিগেড, সার্জেন্ট জহুর বাহিনী। এদের সদস্যরা ভেঙে পড়া পাকিস্তানি শাসনের পরিবর্তে যানবাহন চলাচল, ট্রেন-স্টিমার চালু রাখা, শিল্পকারখানায় উৎপাদন অব্যাহত রাখা এবং থানা পর্যায়ে আইনশৃঙ্খ্লা রক্ষা করার দায়িত্ব পালন করে।
নিউক্লিয়াসের সদস্যদের দ্বারা এসব দুরূহ কাজ সম্পাদনের জন্য কৌশল ও পরিকল্পনাও নিউক্লিয়াসের। এ ছাড়া জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ গঠন এবং ৭ নভেম্বর ১৯৭৫-এর নেপথ্য পরিকল্পনাকারী ছিলেন। তার রাজনৈতিক দর্শনকে অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র গঠনে দিশারি হিসেবে অভিহিত করেন স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলক এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব। সিরাজুল আলম খান জাতি-রাষ্ট্র নির্মাণে একদিকে যেমন অন্যতম একজন রূপকার ও কারিগর ছিলেন, তেমনি জাতীয়তাবাদ বিকাশের পথপ্রদর্শক হিসেবেও ইতিহাসে স্মরণীয়। তার রাজনৈতিক কর্মসূচি অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের নতুন ভিত্তিস্থাপন করে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক অগ্রযাত্রা ত্বরান্বিত করতে সহায়ক।
সিরাজুল আলম খানের উচ্চাশিক্ষা গণিতশাস্ত্রে হলেও দীর্ঘ জেলজীবনে তিনি দর্শন, সাহিত্য, শিল্পকলা, রাজনীতি-বিজ্ঞান, অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, সমাজবিজ্ঞান, পরিবেশবিজ্ঞান, সামরিক বিজ্ঞান, মহাকাশ বিজ্ঞান, সংগীত, খেলাধুলা সম্পর্কিত বিষয়ে ব্যাপক পড়াশোনা করেন। ফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ওপর গড়ে উঠে তার অগাধ পাণ্ডিত্য ও দক্ষতা। সেই কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক নিযুক্ত হন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন রাজ্যের ওশকোশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯৬-৯৭ সালে। আর্থসামাজিক বিশেষণে সিরাজুল আলম খানের তাত্ত্বিক উদ্ভাবন বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়। মার্কসীয় ‘দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ’-এর আলোকে বাংলাদেশের জনগণকে শ্রমজীবী-কর্মজীবী-পেশাজীবী হিসেবে বিভক্ত করে ‘রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক’ মডেল হাজির করেছেন সিরাজুল আলম খান। সিরাজুল আলম খান সেন্টার ও রিসার্চ ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান রায়হানুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ‘স্বাধীনতার রূপকার সিরাজুল আলম খান সেন্টারের উদ্বোধন’ অনুষ্ঠানে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেন, তার অংশীদারত্বের গণতন্ত্রই স্বৈরাচার, দলতন্ত্র এবং ফ্যাসিবাদের ভিত্তিমূলে আঘাত হেনে নতুন এক অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠিত করবে। তিনি আরও বলেন, সিরাজুল আলম খানের ১৪ দফাখ্যাত নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা ছাত্র-জনতার জুলাই গণঅভ্যুত্থানের চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই কর্মসূচিতে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত। ভবিষ্যতে যেকোনো ফ্যাসিবাদী শাসন প্রতিরোধে এটি সুস্পষ্ট রূপরেখা। সভায় বক্তব্য দেন রাষ্ট্রচিন্তক গবেষক সলিমুল্লাহ খান, বিএনপি নেতা আব্দুস সালাম, জেএসডি সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন, বাংলাদেশ জাসদের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান, বিএনপি নেতা শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, সাখাওয়াত হোসেন টুটুলসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক ব্যক্তিত্ব।